Ticker

6/recent/ticker-posts

হিন্দু ধর্মে যুগ বিভাজনের সত্যতা যাচাই

হিন্দু ধর্মে যুগ বিভাজনের সত্যতা যাচাই


হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী চার যুগ – সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। এই যুগ বিভাজন ঐতিহাসিক ভাবে কতোটা সত্য? এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চার যুগের কথা পাওয়া যায় হিন্দু ধর্ম গ্ৰন্থে। মহাভারতে রয়েছে - 
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি পুরাকালের সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সম্বন্ধে কিছু শুনতে ইচ্ছা করি। মার্কণ্ডেয় বললেন, সত্য যুগের পরিমাণ চার হাজার বৎসর (১), তার সন্ধ্যা (২) চার শ, এবং সন্ধ্যাংশ (৩)ও চার শ বৎসর। ত্রেতা যুগ তিন হাজার বৎসর, তার সন্ধ্যা তিন শ বৎসর, সন্ধ্যাংশ‌ও তাই। দ্বাপর যুগ দু হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ দুইই দুশো বৎসর। কলিযুগ এক হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ এক‌-এক শ বৎসর। চার যুগে বার হাজার বৎসর; এক হাজার যুগে (এক হাজার চতুর্যুগে) ব্রহ্মার এক দিন। তারপর ব্রহ্মার রাত্রি প্রলয়কাল। 
(১) অনেকে বৎসরের অর্থ করেন দৈব বৎসর, অর্থাৎ মানুষের ৩৬০ বৎসর।
(২) যে কালে যুগলক্ষণ ক্ষীণ হয়ে।
(৩) যে কালে পরবর্তী যুগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

মহাভারত, বনপর্ব, মার্কণ্ডেয়সমস্যাপর্বাধ্যায়, (৩৯) বৈবস্বত মনু ও মৎস্য — বালকরূপী নারায়ণ, মহাভারত সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
মহাভারতে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী সত্য যুগের পরিমাণ ৪৮০০ দৈব বৎসর যা মানুষের জন্য ১৭২৮০০০ বছর। ত্রেতা যুগের পরিমাণ ৩৬০০ দৈব বৎসর যা মানুষের জন্য ১২৯৬০০০ বছর। দ্বাপর যুগের পরিমাণ ২৪০০ দৈব বৎসর যা মানুষের জন্য ৮৬৪০০০ বছর। কলি যুগের পরিমাণ ১২০০ দৈব বৎসর যা মানুষের জন্য ৪৩২০০০ বছর। 

হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী রামের জন্ম হয়েছিল ত্রেতা যুগে এবং রামের মৃত্যুর পর ত্রেতা যুগ শেষ হয়ে দ্বাপর যুগের সূচনা হয়েছিল। কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল দ্বাপর যুগে এবং কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বাপর যুগ শেষ হয়ে কলিযুগের সূচনা হয়েছিল। তাহলে রামের মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে ৮৬৯১২২ বছর পূর্বে। কৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে ৫১২২ বছর পূর্বে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী কৃষ্ণ ১২৫ বছর বেঁচেছিলেন। তাহলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ৫২৪৭ বছর আগে অর্থাৎ ৩২২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। যেহেতু রামচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল ত্রেতা যুগের শেষে এবং কৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছিল দ্বাপর যুগের শেষে তাই রামের মৃত্যু ও কৃষ্ণের মৃত্যুর মধ্যে ২৪০০ দৈব বৎসর অর্থাৎ ৮৬৪০০০ বছরের অন্তর থাকা উচিত। এই অনুযায়ী রামের মৃত্যু হয়েছিল ৮৬৭১০২ খ্রিস্ট্র পূর্বাব্দে। 

বর্তমানে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। হিন্দু দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ৫১২২ কলিযুগাব্দ। কলিযুগ ৫১২২ বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল। গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩১০২ খ্রিস্ট পূর্বে কলিযুগের সূচনা হয়েছিল। 

এবার দেখা যাক বর্তমান সময়ের হিন্দু পণ্ডিতরা রামের জন্ম নিয়ে কী তথ্য দিয়েছেন। Institute of Scientific Research on Vedas - এই সংস্থা বেদ নিয়ে গবেষণা করে তবে আজ পর্যন্ত বেদ পড়ে বিজ্ঞানের কোনো কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি। এই সংস্থা জানিয়েছে ৫১১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রামের জন্ম হয়েছিল এবং ৩২২৮ খ্রিস্ট্রপূর্বাব্দে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। 

তাহলে কৃষ্ণের জন্ম মিলিয়ে দিয়েছে কিন্তু রামের জন্ম মিলাতে পারেনি। রামায়ণের আট লক্ষ বছরের গল্প তাহলে ভুল। 

হিন্দু ধর্মের যুগ বিভাজন রয়েছে মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যাপর্বাধ্যায়ে। এই মার্কণ্ডেয়সমস্যাপর্বাধ্যায় সম্পর্কে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যা বলেছেন দেখা যাক -

তার পর বনপর্বের শেষের দিকে মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণকে দেখিতে পাই। পাণ্ডবেরা কাম্যক বনে আসিয়াছেন শুনিয়া, কৃষ্ণ তাহাদিগকে আবার দেখিতে আসিয়াছিলেন–এবার একা নহে; ছোট ঠাকুরাণীটি সঙ্গে। মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায় একখানি বৃহৎ গ্ৰন্থ বলিলেও হয়। কিন্তু মহাভারতের সঙ্গে সম্বন্ধ আছে, এমন কথা উহাতে কিছুই নাই। সমস্তটাই, প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বোধ হয়। পর্বসংগ্ৰহাধ্যায়ে মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ের কথা আছে বটে; কিন্তু অনুক্রমণিকাধ্যায়ে নাই। মহাভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের রচনার সঙ্গে ইহার কোন সাদৃশ্য‌ই নাই। কিন্তু ইহা মৌলিক মহাভারতের অংশ কিনা, তা হা আমাদের বিচার করিবার‌ও কোন‌ প্রয়োজন রাখে না। কেন না, কৃষ্ণ এখানে কিছুই করেন নাই। আসিয়া যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী প্রভৃতিকে কিছু মিষ্ট কথা বলিলেন, উত্তরে কিছু মিষ্ট কথা শুনিলেন। তার পর কয় জন মিলিয়া ঋষি ঠাকুরের আষাঢ়ে গল্প সকল শুনিতে লাগিলেন। 

কৃষ্ণচরিত্র, চতুর্থ খণ্ড, একাদশ পরিচ্ছেদ – পাণ্ডবের বনবাস, কৃষ্ণচরিত্র – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যুগ বিভাজন যেই অংশে রয়েছে সেটাকে আষাঢ়ে গল্প বলে এই চার যুগকে বাতিল করেছেন।

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান প্রবীর ঘোষ এই যুগ বিভাজন সম্পর্কে বলেছেন -
মানব সভ্যতা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগে মোট ৩৮ লক্ষ ৮৮ হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছে এমনটা যাঁরা ভাবেন, তাঁদের 'বোকা' বললে বোকাদের-ই অসম্মান করা হয়। 

যুক্তিবাদীর চোখে গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি – প্রবীর ঘোষ
 

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক যুগ বিভাজন সম্পর্কে বলেছেন -
সুতরাং পৌরাণিক সত্যযুগের কথা যাহা ১৭,২৮,০০০ বৎসর স্থায়ী এবং বর্তমান সময়ের ২১,৬৫,০ ৪ ০ বৎসর পূর্বে শেষ হইয়াছিল বলিয়া প্রচার করা হয়, তাহা সম্পূর্ণ অলীক ও ভ্রান্ত। 

সব‌ই ব্যাদে আছে – মেঘনাদ সাহা 
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী রামায়ণের গল্প খুব প্রাচীন না। বৌদ্ধ জাতকের দশরথ জাতক গল্প থেকেই পরবর্তীতে রামায়ণের গল্প লেখা হয়েছে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই কথাই বলেছিলেন।
হিন্দু ধর্মের যুগ বিভাজন শুধুমাত্র কাল্পনিক। এর পিছনে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাস না করে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্যতা যাচাই করলে সহজেই বোঝা যায় ধর্মের কাহিনীগুলো শুধুমাত্র কাল্পনিক। ভক্তিতে নয় ভরসা রাখুন যুক্তিতে।


তথ্যসূত্রঃ
১) মহাভারত সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
২) কৃষ্ণচরিত্র - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩) যুক্তিবাদীর চোখে গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি - প্রবীর ঘোষ


Post a Comment

2 Comments

  1. আপনার কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়।

    ReplyDelete