Ticker

6/recent/ticker-posts

সত্যতা যাচাই - হনুমান চালিশায় কি পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্ব বলা হয়েছে?

চিন্তা মুক্তি

সত্যতা যাচাই - হনুমান চালিশায় কি পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্ব বলা হয়েছে?


ইসলামের জাকির নায়েকের মতো হিন্দু ধর্মের মধ্যেও রয়েছে কিছু মানুষ যারা যেকোনো ধর্মীয় গ্ৰন্থে বিজ্ঞান খুঁজতে থাকে, ধর্মকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের চেষ্টা করে। হিন্দুদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি গ্ৰন্থ হনুমান চালিশা। হনুমান চালিশাকে কোনো গ্ৰন্থ না বলে চল্লিশটি চৌপাঈ বা শ্লোকের একটি কবিতা বা গান বলতে গেলে ভালো হয়।ষোল শতকের কবি তুলসীদাস অবধি ভাষায় হনুমান চালিশা রচনা করেন। বর্তমানে অবশ্য ভারতের বহু ভাষাতেই এটি উপলব্ধ।
হনুমান চালিশার একটি চৌপাঈ-এ সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্ব বলা হয়েছে – এমনটাই দাবি করে কিছু হিন্দু। তারা ১৮ নম্বর চৌপাঈ দেখিয়ে এমন দাবি করে। তাহলে দেখে নেওয়া যাক হনুমান চালিশার ১৮ নম্বর চৌপাঈ বা শ্লোক।

जुग सहस्र जोजन पर भानू।
लील्यो ताहि मधुर फल जानू।।


ইংরেজিতে এর উচ্চারণ এইরকম
Yuga sahasra yojana para bhanu |
Lilyo tahi madhura phala janu ‖

বাংলায় এর উচ্চারণ এইরকম
যুগ সহস্র যোজন পর ভানূ |
লীল্যো তাহি মধুর ফল জানূ ||

বাংলা অনুবাদ :
এক যুগ সহস্র যোজন দূরে অবস্থিত যে সুর্যদেব তাকে আপনি মিষ্ট ফল জ্ঞানে গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

এর মধ্যে কীভাবে বিজ্ঞান পেলো হিন্দুত্ববাদীরা? 
প্রথম তিন শব্দের মধ্যেই সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্ব বলে দাবি করে হিন্দু গুরুরা।
দেখা যাক কীভাবে তারা গণণা করে?
যুগ=১২০০০
সহস্র=১০০০
যোজন= ১২.৮
এবার , যুগ×সহস্র×যোজন
=১২০০০×১০০০×১২.৮
=১৫৩৬০০০০০

বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুযায়ী পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫৩৬০০০০০ কিলোমিটার। এটি হনুমান চালিশার হিসাবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তাহলে কি মেনে নেওয়া হবে হনুমান চালিশায় সত্যিই জ্যোতির্বিজ্ঞান রয়েছে?

এবার এটির সত্যতা যাচাই করা যাক
প্রথমেই প্রশ্ন হবে এখানে যুগ=১২০০০ কেনো নেওয়া হয়েছে? হনুমান চালিশার এই ‘বিজ্ঞান’ জানা না থাকলে একজন সাধারণ হিন্দুর‌ও এক‌ই প্রশ্ন হ‌ওয়া স্বাভাবিক। কারণ হিন্দুরা যুগ বলতে চার যুগ বোঝায় – সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। এবার যুগ=৪ করলে দূরত্ব হয়ে যাবে ৫১২০০ কিলোমিটার। তাহলে হনুমান চালিশাকে কোনো বিজ্ঞান গ্ৰন্থ প্রমাণ করা গেলো না।

এরপর‌ই হিন্দু বৈদিক বিজ্ঞানীরা বলে এখানে যুগ=১২০০০ নেওয়া হয়েছে কারণ ১২০০০ দৈব বছরে চার যুগ হয়।
বিজ্ঞানের একটি সাধারণ সূত্র রয়েছে যা সমমাত্রিক নীতি বা Principal of dimensional homogeneity নামে পরিচিত। এই সূত্র অনুযায়ী - কোনো সঠিক সমীকরণের দুই দিকে সর্বদা অভিন্ন মাত্রা হবে।
এই সূত্র অনুযায়ী যাচাই করা যাক যুগ=১২০০০ হলে এটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক কিনা।
যুগ×সহস্র×যোজন
=(১২০০০দৈববছর)×১০০০×(১২.৮কিলোমিটার)
=১৫৩৬০০০০০ দৈববছর-কিলোমিটার
মাত্রা হবে [LT]
কিন্তু দৈর্ঘ্যের মাত্রা হয় [L]
তাহলে বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুযায়ী এই গণণাটি সঠিক না।

এটা শুধুমাত্র যুগ নিয়ে আলোচনা হলো। যুগ সম্পর্কে আলোচনাতে কোনো বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া গেলো না।

সহস্র মানে ১০০০ – এটি সবাই জানে। এবার তাহলে যোজন নিয়ে আলোচনা হোক।

যোজন দৈর্ঘ্য পরিমাপের রাশি।এই যোজন নিয়ে সমস্যা আরও বেশি। এক যোজন বলতে ঠিক কতটা দৈর্ঘ্য বোঝায় তা নির্দিষ্ট নয়। যোজন বলতে ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার বোঝায়। হনুমান চালিশায় কোথাও বলা নেই যোজন=১২.৮ ধরে হিসাব করতে হবে। শুধুমাত্র সংখ্যাগত মান মিলানোর জন্য যোজন এর একটি নির্দিষ্ট মান নেওয়া হয়েছে। যোজনের মান ১২, ১২.৯, ১৩, ১৩.১, ১৪, ১৪.৫, ১৫ এই মানগুলি নিয়ে হিসাব করলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আসবে না। যোজনের হিসাব বিভিন্ন ভাবে নিয়ে একাধিক মান আসবে, এগুলো পৃথিবী থেকে সূর্যের সর্বাধিক দূরত্ব বা সর্বনিম্ন দূরত্ব বা গড় দূরত্ব এগুলির সঙ্গে মিলবে না।

হনুমান চালিশা কোনো বিজ্ঞান ব‌ই না, এটি একটি সাহিত্যের ব‌ই। এবার দেখা যাক অন্য ভাষায় হনুমান চালিশার অনুবাদ।
বাংলায় অনুবাদ
সহস্র যোজন ঊর্ধ্বে সূর্য্যদেবে দেখে।
সুমধুর ফল বলি ধাইলে গ্ৰাসিতে।।

অসমীয়া ভাষায় অনুবাদ দেখা যাক
সহস্ৰ যোজন ঊৰ্ধ্বে সূৰ্য্যদেৱে দেখে।
সুমধুৰ ফল বুলি ভাবে একে গ্ৰাসে॥
বাংলা এবং অসমীয়া দুই ভাষার অনুবাদেই ‘যুগ' শব্দটিকে‌ই বাদ দেওয়া হয়েছে। যুগ না থাকলে তো হিসাব‌ও মিলবে না। অনুবাদ সাহিত্যের দিক থেকেও এখানে কোনো বিজ্ঞান পাওয়া যাবে না।যেই কবিরা বাংলা, অসমীয়া অনুবাদ করেছেন তাঁরা এটিকে শুধুমাত্র সাহিত্যিক অনুবাদ ধর্ম গ্ৰন্থ হিসেবে মেনেই করেছেন, তাঁরা হনুমান চালিশাকে বিজ্ঞানের বই হিসেবে অনুবাদ করেননি। 

হনুমান চালিশায় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব নেই কারণ
  • যুগ বলে একাধিক অর্থ করে শুধুমাত্র হিসাবে মিলানোর চেষ্টা হয়েছে।
  • যোজনের নির্দিষ্ট মান নেই, বিভিন্ন মানে বিভিন্ন ফলাফল আসবে।
  • এখানে যোজনের একটি মানে সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব হিসাব করা হয়েছে। বাস্তবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের হ্রাস বৃদ্ধি হয়। এই সম্পর্কে হনুমান চালিশায় কিছু বলা নেই।
  • যুগ, সহস্র, যোজন এই তিনের মান কেন যোগ করা হয়নি? কারণ, এক্ষেত্রে হিসাব মিলবে না। শুধুমাত্র একটি সংখ্যা মিলানোর জন্য গুণ করে দেওয়া হয়েছে। যুগ, সহস্র, যোজন গুণ করা হবে এমন কোথাও বলা নেই হনুমান চালিশায়।
  • যুগ, সহস্র, যোজন সরাসরি গুণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মান মিলে গেছে কিন্তু মাত্রা মিলেনি। সমমাত্রিক নীতি বা Principal of dimensional homogeneity অনুযায়ী এটি ভুল।
  • বাংলা, অসমীয়া অনুবাদ অনুযায়ী কখনো‌ই হিসাব মিলবে না।
বর্তমানে ধর্মের ব্যবসায়ীরা অপপ্রচার করে ধর্ম, ঈশ্বরের বিশ্বাসকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মের কল্পকাহিনী থেকে বের হয়ে বাস্তববাদী হোন। যুক্তিবাদী মনে ধর্মীয় পুস্তক পড়ুন তাহলেই ধর্মের অবৈজ্ঞানিক রূপ প্রকাশ পাবে। ভক্তিতে নয় ভরসা রাখুন যুক্তিতে।



Post a Comment

0 Comments