Ticker

6/recent/ticker-posts

গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধান্ত — ঈশ্বরকে অস্বীকার করা

গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধান্ত — ঈশ্বরকে অস্বীকার করা


 ঈশ্বরকে অস্বীকার করা; অন্যথায় 'মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু' — এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়।

ঈশ্বরবাদীরা বলে থাকেন — যেহেতু প্রতিটি কর্মের পেছনে একটি কারণ থাকে অত‌এব এই বিশ্ব-সংসারের সৃষ্টিরও কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে এবং সেই কারণ‌ই ঈশ্বর। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ঈশ্বরের প্রকার কী? সেটি কী উপাদান প্রকার, যেমন মাটির ঘড়ার উপাদান মাটি, কিংবা সুবর্ণ কুণ্ডলের উপাদান সোনা? যদি ঈশ্বর জগতের উপাদান কারণ হয় তাহলে জগৎ ঈশ্বরের রূপান্তর। তাহলে সংসারে ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখ, দয়া-ক্রূরতা যা সচরাচর আমরা দেখে থাকি, সব‌ই ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত এবং ঈশ্বরে বর্তমান। যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বর সুখময় নয়, বরং অনেক বেশি দুঃখময়, কারণ পৃথিবীতে দুঃখের পাল্লাই ভারী। ঈশ্বর যত না দয়ালু তদপেক্ষা অনেক বেশি ক্রূর। কারণ পৃথিবীর চতুর্দিকে ক্রূরতার‌ই আস্ফালন। যদি গাছপালা ইত্যাদিকে সজীব নাও মনে করি; তাহলেও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে কীটানু থেকে আরম্ভ করে কীট-পতঙ্গ, খেচর পক্ষীকুল, জলচর মৎস্য, সর্প ইত্যাদি সরীসৃপ, শৃগাল, নেকড়ে, বাঘ, সিংহ — সভ্য অসভ্য মানুষ সকলেই পরস্পরের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন। চোখ বুজে ভাবলে পৃথিবীর দৃশ্য, অদৃশ্য সমস্ত অংশ‌ই এক রোমাঞ্চকারী রণক্ষেত্র। যেখানে দুর্বলেরা সবলের গ্ৰাসে পরিণত হচ্ছে। পুনর্জন্মে অবিশ্বাসী ধর্মের এই তত্ত্বকে তো বিনা বিরোধিতায় গ্ৰহণ করা উচিত। পুনর্জন্মবাদীরা তবু বলতে পারে যে সমস্ত দুঃখকষ্ট‌ই পূর্ব জন্মের কর্মফলে। তবু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। ভালোমন্দের পার্থক্য হয়তো জ্ঞানী লোকের পক্ষে করা সম্ভব। কিন্তু উন্মাদ, বেহুঁশ, নেশাগ্ৰস্ত ব্যক্তি যদি কার‌ও মৃত্যুর‌ও কারণ হয়; তার জন্য তাদের সর্বতো ভাবে দায়ী করা যায় কি? কিংবা একথা কি অস্বীকার করা চলে যে মনুষ্যজগতের বাইরে অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভালোমন্দ বিচারবোধ‌ই নেই, কিংবা যাদের জীবন আরেকজনের মৃত্যুর উপর‌ই নির্ভরশীল — তাদের কি তাদের কর্মফলের জন্য দায়ী করা চলে? মানুষের মধ্যে শিশু, বালক এবং উন্মাদদের পৃথক করে দিলে, কর্মফলের দায়িত্ব নিতে পারে এমন সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অনেক কমে যাবে। যদি ধরে নেওয়া হয় কর্মফলের জন্য জবাবদিহি করতে পারে বা করা উচিত, এমন সংখ্যা দেড়শো কোটি ধরা হয়, তাহলে কর্মফল ভোগ করার জন্য বিশাল সংখ্যা কোত্থেকে আসবে? পৃথিবীতে কচ্ছপের সংখ্যাই হয়তো দেড়শো কোটি হবে, যারা মানুষের তুলনায় দীর্ঘজীবী, আর কীটানু, হাতি, সমুদ্রের তিমি ইত্যাদি কোন কর্মফল ভোগ করছে?

উপাদান-কারণ বর্তমান থাকলে তা কীভাবে নির্বিকার হতে পারে? যদি ঈশ্বরকে নিমিত্ত কারণরূপে স্বীকার করা যায়, অর্থাৎ তিনি জগৎ এমনভাবে সৃষ্টি করেন যেভাবে কুম্ভকার তার কলসি অথবা স্বর্ণকার তার গহনা তৈরি করে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে এই সৃষ্টি কী করে হয়? কোনো উপাদান-কারণ ব্যতিরেকেই অথবা উপাদান-কারণের সাহায্যে‌? যদি উপাদান-কারণ ব্যতিরেকেই এটা সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বস্তুজগৎ থেকে ভাব জগতে প্রবেশ করতে হবে, এবং সে অবস্থায় কার্য-কারণ সম্বন্ধীয় সমস্ত সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে। তাহলে পৃথিবীকে দেখে, তার সৃষ্টির পশ্চাতে ঈশ্বরের ভূমিকা স্বীকার করার‌ই বা কী প্রয়োজন? যদি ইন্দ্রজালের মতো কোনো কার্য-কারণ ব্যতিরেকেই এই মায়াময় জগৎ সৃষ্টি সম্ভব, তাহলে প্রত্যেক বস্তু মায়াময় হলে ঈশ্বরের উপস্থিতি কোন যুক্তিতে টিকে থাকবে? যদি উপাদান-কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তা কীভাবে? কুম্ভকারের মতো বস্তু থেকে পৃথক হয়ে, নাকি বস্তুতে ব্যাপ্ত হয়ে? যদি পৃথক হয়ে থাকে তাহলে ঈশ্বর সর্বব্যাপ্ত নয় এবং সৃষ্টি করার জন্য তার অপরের সাহায্য কিংবা সাধনের প্রয়োজন। পরমাণুর চেয়েও সূক্ষ নবকণ (Neutron) পর্যন্ত পৌঁছতে এবং তার মিশ্রণে ক্রমশ স্থূলতর বস্তু সৃষ্টি করতে তার কী কী যন্ত্রপাতি, বীক্ষণাগারের প্রয়োজন হয়েছে? যেমন স্বর্ণকারের হয় সাঁড়াশি ইত্যাদি বস্তুর। এবং সে অবস্থায় ঈশ্বর কীভাবে সর্বশক্তিমান হতে পারে? যদি উপাদান-কারণ সর্বব্যাপক মেনেও নেওয়া যায় তবুও উপাদান-ব্যতিরেকে সৃষ্টিতে অক্ষম ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা চলে না। এমতাবস্থায় অপবিত্রতা, ক্রূরতা প্রভৃতি দোষের উৎস হিসেবে ঈশ্বরেরই দায়িত্ব থেকে যায়।

এভাবে ঈশ্বর না-উপাদান-কারণ না-নিমিত্ত-কারণ। জগৎ সৃষ্টির একটা কারণ থাকতেই হবে এটা আবশ্যিক নয়। যদি জগৎ সৃষ্টির পিছনে কী কারণ আছে এই প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তো বিশ্বের কোনো সূক্ষতম বস্তু বা কোনো বিশেষ শক্তিকে অতিক্রম করে ঈশ্বরেরই সীমাবদ্ধ থাকে না, ঈশ্বরের সৃষ্টি‌ই বা কীভাবে হল সেই প্রশ্ন‌ও এসে যায়। এজন্য‌ই ঈশ্বরকে আদি কারণ স্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয়।

ঈশ্বর সর্বময় কর্তা, মানুষ তার হাতের পুতুল মাত্র, তাহলে ভালো বা মন্দ কাজের জন্য মানুষ কেন জবাবদিহি করবে? মানুষকে পৃথিবীতে দুঃখকষ্ট দিয়ে ঈশ্বর কোন দয়ালুতার পরিচয় রেখেছেন?

ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা একথা মানার কোনো অর্থ হয় না। যদি সৃষ্টি অনাদি হয়, তাহলে তার জন্য কোনো প্রভুর প্রয়োজন নেই, কারণ, সৃষ্টির যদি কোনো প্রভু থাকে, তাকে কার্যের পূর্বেই কার্যস্থলে উপস্থিত থাকা দরকার। যদি সৃষ্টি আদি হয়, তাহলে এক কোটি, দুই কোটি, এক অর্বুদ, দুই অর্বুদ বর্ষ নয়, অচিন্তনীয়, অনন্তবর্ষ থেকে সৃষ্টি উৎপন্ন হ‌ওয়া পর্যন্ত-নিষ্ক্রিয় ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ কী?

ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিলে, মানুষকে তার অধীন, মেনে নিতে হয়। সে অবস্থায়, মানুষ 'নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা' এই তত্ত্ব থেকে সরে আসতে হয়। তাহলে মানুষের আপন উন্নতির জন্য চেষ্টা করার প্রশ্ন‌ই বা ওঠে কীভাবে? সুতরাং প্রশ্ন ওঠে ধর্মের এবং সেক্ষেত্রে ধর্ম‌ও তো নিষ্ফল। ঈশ্বরকে অস্বীকার করলে মানুষ বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা মানুষেরই সৃষ্টি এবং ভবিষ্যত‌ও মানুষের হাতেই। মানুষের নিজস্ব কর্মের স্বাধীনতার মধ্যে‌ই ধর্ম স্বার্থক হতে পারে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ঈশ্বরবাদীরা ধর্মের নামে যে রক্তস্রোত প্রবাহিত করেছে, কেন ঈশ্বর তা রোধ করার চেষ্টা করেনি? কারণ ঈশ্বর মানুষের‌ই মনোজগতের সৃষ্টি



তথ্যসূত্রঃ বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন

Post a Comment

0 Comments