Ticker

6/recent/ticker-posts

জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিচারিতা / Swami Vivekananda and Caste System

জাতিভেদ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিচারিতা
Swami Vivekananda and Caste System


ছোটোবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় স্বামী বিবেকানন্দ মহান জ্ঞানী, তাঁর কোনো ভুল হতে পারে না। আমরা বিবেকানন্দকে চিনি তাঁর কিছু ভালো বাণীর মাধ্যমে কিন্তু খুব কম মানুষই বিবেকানন্দের সমস্ত লেখা পড়ে থাকেন। এমনকি বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সংগ্রহ থাকলেও কোনোদিন পড়েনি। বিবেকানন্দের সমস্ত লেখা পড়লে একাধিক ভুল, স্ববিরোধীতা, সভ্য সমাজে বর্জিত চিন্তাধারা, অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীন কথা পাওয়া যাবে। স্বামী বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কেও স্ববিরোধী মন্তব্য করেছেন। এখানে জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তব্য আলোচনা করা হয়েছে।

১৮৯৬ খৃঃ ২৫শে মার্চ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (U.SA.) গ্ৰাজুয়েট ফিলজফিক্যাল সোসাইটির সভায় বেদান্ত দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতার পর শ্রোতাদের সহিত স্বামীজীর প্রশ্নোত্তর আলোচনা হয়েছিল। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে যা বলেছিলেন শুধুমাত্র সেই কথাগুলি তুলে ধরছি।

প্র। খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কে ভারতবাসীর কিরূপ ধারণা?
উ। ….এরূপ হ‌ওয়া খুব সম্ভব যে, আমি হয়তো দ্বৈতবাদী, আমার স্ত্রী অদ্বৈতবাদী। আমার কোন পুত্র ইচ্ছা করিলেই খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদের উপাসক হ‌ইতে পারে, তিনিই তাহার ইষ্ট। অবশ্য তাহাকে জাতিগত সামাজিক নিয়ম প্রতিপালন করতেই হ‌ইবে
জন্ম শতবর্ষ স্মরণে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - দ্বিতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ পৌষ-কৃষ্ণাসপ্তমী,১৩৬৭, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, প্রশ্নোত্তরে আলোচনা (পৃষ্ঠা – ৪৫৪-৪৫৫)

প্র। সকল হিন্দু‌ই কি জাতিবিভাগে বিশ্বাসী?
উ। বাধ্য হ‌ইয়া নিয়ম মানিতে হয়। আস্থা না থাকিলেও সামাজিক নিয়ম তাহাদের মানিতেই হয়।
জন্ম শতবর্ষ স্মরণে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - দ্বিতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ পৌষ-কৃষ্ণাসপ্তমী,১৩৬৭, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, প্রশ্নোত্তরে আলোচনা (পৃষ্ঠা – ৪৫৫-৪৫৬)

প্র। যোগীরাকি জাতিভেদকে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকে?
উ। না; জাতিবিভাগ অপরিণত মনের শিক্ষালয় মাত্র।
জন্ম শতবর্ষ স্মরণে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - দ্বিতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ পৌষ-কৃষ্ণাসপ্তমী,১৩৬৭, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, প্রশ্নোত্তরে আলোচনা (পৃষ্ঠা – ৪৬১) 

প্র। আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বসাধারণের এই স্বাধীনতার সহিত জাতিভেদ স্বীকারের কি সামঞ্জস্য আছে?
উ। কখন‌ই না। লোকে বলিয়া থাকে, জাতিভেদ থাকা উচিত নয়। এমন কি যাহারা বিভিন্ন জাতিভুক্ত তাহারা‌ও বলে, জাতিবিভাগ একটা খুব উঁচুদরের জিনিস নয়। কিন্তু তাহারা সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলে যে, আমাদের ইহা অপেক্ষা ভালো অন্য কোন জিনিস দাও, আমরা ইহা ছাড়িয়া দিব। তাহারা বলে, তোমরা ইহার বদলে আমাদিগকে কি দিবে? জাতিভেদ কোথায় নাই? তোমরাও তো তোমাদের দেশে এইরূপ একটা জাতিবিভাগ গড়িবার চেষ্টা করিতেছ। কোন ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেই বলিয়া বসে, কয়েক শত ধনীর মধ্যে আমিও একজন। আমরাই কেবল একটা স্থায়ী জাতিবিভাগ গঠন করিতে সমর্থ হ‌ইয়াছি। অপরে উহার জন্য চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু সফল হ‌ইতেছে না। আমাদের সমাজে অবশ্য যথেষ্ট কুসংস্কার ও মন্দ জিনিস আছে। আপনাদের দেশে কুসংস্কার ও মন্দ জিনিসগুলি আমাদের দেশে চালাইয়া দিতে পারিলেই কি সব ঠিক হ‌ইয়া যাবে? জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ কোটি লোক এখনও খাইবার এক টুকরা রুটি পাইতেছে। অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোন‌ই সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আপনারা পড়িবার জন্য একখানি সংস্কৃত ব‌ইও পাইতেন না। এই জাতিবিভাগের দ্বারা এমন একটি দৃঢ় প্রাচীরের সৃষ্টি হ‌ইয়াছিল যে, উহার উপর বহিরাক্রমণের শত প্রকার তরঙ্গাঘাত আসিয়া পড়িয়াছে, অথচ কোন মতেই উহাকে ভাঙিতে পারে নাই। এখন‌ও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে। সাত শত বর্ষ পূর্বে যেরূপ জাতিবিভাগ ছিল, এখন আর সেরূপ নাই। যত‌ই উহার উপর আঘাত লাগিয়াছে, তত‌ই উহা দৃঢ়তর আকার ধারণ করিয়াছে।
জন্ম শতবর্ষ স্মরণে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - দ্বিতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ পৌষ-কৃষ্ণাসপ্তমী,১৩৬৭, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, প্রশ্নোত্তরে আলোচনা (পৃষ্ঠা – ৪৬৩)

স্বামী বিবেকানন্দের নিজস্ব মতামত থেকে আমরা যা পেলাম তা নিম্নরূপ⁚
জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের বক্তব্য⁚

  • জাতিবিভাগ অপরিণত মনের শিক্ষালয় মাত্র।
  • লোকে বলিয়া থাকে, জাতিভেদ থাকা উচিত নয়।
  • এমন কি যাহারা বিভিন্ন জাতিভুক্ত তাহারা‌ও বলে, জাতিবিভাগ একটা খুব উঁচুদরের জিনিস নয়।
জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে বিবেকানন্দের বক্তব্য⁚

  • আমার কোন পুত্র ইচ্ছা করিলেই খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদের উপাসক হ‌ইতে পারে, তিনিই তাহার ইষ্ট। অবশ্য তাহাকে জাতিগত সামাজিক নিয়ম প্রতিপালন করতেই হ‌ইবে। ( এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে বিবেকানন্দ বিবাহিত ছিলেন না, তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে এই কথাটা বলেছেন।)
  • বাধ্য হ‌ইয়া নিয়ম মানিতে হয়। আস্থা না থাকিলেও সামাজিক নিয়ম তাহাদের মানিতেই হয়।
  • জাতিভেদ কোথায় নাই? তোমরাও তো তোমাদের দেশে এইরূপ একটা জাতিবিভাগ গড়িবার চেষ্টা করিতেছ।
  • জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ কোটি লোক এখনও খাইবার এক টুকরা রুটি পাইতেছে। 
  • এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আপনারা পড়িবার জন্য একখানি সংস্কৃত ব‌ইও পাইতেন না।
  • এখন‌ও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে।
স্বামী বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে স্ববিরোধী মন্তব্য করেছেন। কখন‌ও বলেছেন জাতিবিভাগের দরকার নেই আবার পরক্ষণেই জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে বলেছেন। এই স্ববিরোধীতা কেন? জাতিভেদ প্রথাকে তিনি কেন স্পষ্ট বিরোধীতা করেননি? আসলে বিবেকানন্দের এই দ্বিচারিতা পরোক্ষভাবে জাতিভেদ প্রথাকে‌ই সমর্থন করা।

Post a Comment

0 Comments